রেইনবো ফুডের গুণাগুণ ও
রাসায়ণিকযুক্ত ফলমূল , শাকসবজি ও মাছ থেকে বাঁচার উপায়
রংধনুর সাতটি রঙের মত ফলমূল ও
শাকসবজিকে সাতটি রঙে ভাগ করা যায়। ফলমূল ও শাকসবজিতে বিদ্যমান রঞ্জক
পদার্থের কারণেই ফলমূল ও শাকসবজি রঙিন হয়ে থাকে । প্রডিজ ফর বেটার হেল্থ
ফাউন্ডেশন (পিবিএইচ) এর তথ্য অনুসারে এই রঞ্জক পদার্থগুলো এন্টিঅক্সিডেন্ট (
রোগ প্রতিরোধক) হিসেবে কাজ করে, আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ
সরবরাহ করে থাকে এবং ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে । এই
সাতটি রঙের ফলমূল ও শাকসবজিকে একত্রে রেইনবো ফুড বলে । রেইনবো ফুড
আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য অত্যাবশক। তাই প্রতিদিনের খাদ্য
তালিকায় অল্প করে হলেও সাতটি রঙের ফলমূল ও শাকসবজি রাখা উচিত। কখনই একটি
রঙের ফলমূল ও শাকসবজি উচিত না কারণ এতে দেহের চাহিদা পূরণ হয় না, ভিটামিন ও
মিনারেলের অভাবটা থেকেই যায়।
এবার চলুন জেনে নিই প্রতিটি রঙিন ফলমূল ও শাকসবজির স্বকীয় গুণাগুণ:
লাল ফলমূল ও শাকসবজি:
ফলমূল
ও শাকসবজি মূলত উদ্ভিদে উপস্থিত প্রাকৃতিক রঞ্জক পদার্থ লাইকোপেন ও
এ্যান্থেসায়ানিনের কারণে লাল হয়ে থাকে । টমেটো, তরমুজ, লাল পেয়ারা, লাল
পেঁয়াজ, লাল শাকে লাইকোপেন বিদ্যমান যা বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সারের ঝুঁকি
কমাতে সাহায্য করে বিশেষ করে প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ।
স্ট্রবেরী,রাস্পবেরী, ক্র্যানবেরী ,লাল আঙুরে থাকে এ্যান্থেসায়ানিন যা
অত্যন্ত শক্তিশালী এন্টিঅক্রিডেন্ট হিসেবে কাঝ করে, আমাদের দেহের কোষগুলোকে
রক্ষা করে ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।লাল রঙ হলো শক্তি, কর্মোদ্যোগ ও
পরিবর্তনের প্রতীক। যখন আমরা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন থাকি, দুঃসহ সময় কাটাই
তখন খাবার তালিকায় লাল ফলমূল ও শাকসবজির পরিমাণ বাড়ানো উচিত, কারণ লাল
ফলমূল ও শাকসবজি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে। আর যারা
রক্তশূণ্যতায় ভুগছেন এবং ঠান্ডায় সংবেদনশীল তাদের জন্য লাল ফলমূল ও
শাকসবজি অপূরণীয়।
হলুদ ও কমলা ফলমূল ও শাকসবজি:
হলুদ
ও কমলা ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকে বিটা ক্যারোটিন নামক রঞ্জক পদার্থ যা চোখের
দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়, চামড়ায় বলিরেখা পড়া রোধ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়ায়, ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
একটি
সমীক্ষায় দেখা গেছে যারা ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি খেয়ে
থাকেন তাদের বয়স সমন্ধীয় ও চোখের সমস্যা ৪৩% কমে যায় এবং ক্যান্সারের
ঝুঁকি ৩৬% কমে যায়।
কমলা
রঙ হলো আনন্দ ও সুখের প্রতীক । কমলা রঙের ফলমূল ও শাকসবজি মানসিক
স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে যেমন মানসিক প্রশান্তি আনে। অন্যদিকে হলুদ হলো
মনের ও বুদ্ধির রঙ। হলুদ ফলমূল ও শাকসবজি এর মাধ্যমে আমরা বিষণ্ণতা, বাজে
চিন্তা ও অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে পারি।নিজেকে নিয়ন্ত্রণেও হলুদ ফলমূল ও
শাকসবজি ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
সবুজ ফলমূল ও শাকসবজি:
সবুজ
ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকে ক্লোরোফিল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে থাকে লুটেইন( মটর,
কাঁচা মরিচ,শসা ইত্যাদি)। সবুজ ফলমূল ও শাকসবজি এর গুণাগুণ আমরা ছোটবেলায়
সবাই অনেক পড়েছি- সবুজ ফলমূল ও শাকসবজিতে প্রচুর ভিটামিন আছে, এটি
রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে । যারা আমার মত পিসিতে বেশিক্ষণ থাকেন বা
ক্যামেরায় কাজ করেন তাদের উচিত লুটেইন সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে
খাওয়া, এতে চোখের দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখা যায়। সবুজ রঙের ফলমূল ও শাকসবজি
দেহের ওজন কমিয়ে দেহকে সুস্থ রাখে।
বেগুনী, আসমানী ও নীল ফলমূল ও শাকসবজি:
বেগুনী,
আসমানী ও নীল ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকে এ্যান্থেসায়ানিন।আমাদের দেশে
বেগুনী, আসমানী ও নীল ফলমূল ও শাকসবজি খুব কমই আছে । চিত্রের ফলমূল ও
শাকসবজির মাঝে শুধুমাত্র বেগুন আমাদের দেশে পাওয়া যায়।বেগুনী, আসমানী ও
নীল ফলমূল ও শাকসবজি চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, রক্তচাপ কমাতে সাহায্য
করে।
সাদা ফলমূল ও শাকসবজি:
সাদা
ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকে এ্যান্থজেন্তেনি । সাদা ফলমূল ও শাকসবজি কোলস্টেরল
ও রক্তচাপ কমায়, স্টোমাক ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
এতক্ষণ
তো জানলাম ফলমূল ও শাকসবজির নানা গুণাগুণ, কিন্তু আমাদের দেশের যা অবস্থা
তাতে রাসায়নিকমুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি পাওয়ার কোন উপায় নেই।ফলে ফলমূল ও
শাকসবজি খেয়ে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে আমরা অসুস্ত হয়ে পড়ছি|অধিক ফলন পেতে
ব্যবহার করা হচ্ছে অধিক রাসায়নিক সার।ফলমূল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা
হচ্ছে ইথিলিন ও নানা ধরনের রাসায়নিক স্প্রে।মাছে ব্যবহার করা হচ্ছে
ফরমালিন।
খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের উপস্তিতি নানা পরীক্ষার মাধ্যমে করা যায় যেমন-
১।
ফরমালডিহাইডের দ্রবণের সঙ্গে ২ সিসি ফিনাইল হাইড্রোজাইন হাইড্রোকোরাইড
(১%) এবং ১ সিসি ৫% পটাসিয়াম ফেরিসায়ানাড দিয়ে তারপর ৫ সিসি ঘনীভূত
হাইড্রোকোরিক অ্যাসিড মেশালে পুরো দ্রবণ গাঢ় গোলাপী রঙ হয়ে থাকে। একে বলা
হয় সেরিভারস্ টেস্ট।
২।
ফরমালডিহাইডের হালকা দ্রবণ যেমন মাছে ফরমালিন দেয়া আছে তা ধুয়ে তার
পানিতে ১ সিসি সোডিয়াম নাইট্রোপ্রোসাইড মেশালে গাঢ় সবুজ নীল রঙ ধারণ করে।
এতে ফরমালডিহাইড তথা ফরমালিনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এ সমস্ত কেমিক্যাল
এবং রি-এজেন্ট পাওয়া খুব কঠিন এবং দামও অনেক বেশী।
তাই সহজ এবং সাধারণ একটি পদ্ধতি বের করা যায়। যেমন সন্দেহযুক্ত ফরমালিন
মাছ ধুয়ে পানিতে ৩% (ভলিউম) হাইড্রোজেন পারক্সাইড মেশালে ফরমালডিহাইড
অক্সিডাইজড হয়ে ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তর হয়। ফরমিক এসিড প্রমাণের জন্য সে
পানিতে অল্প মারকিউরিক কোরাইড মেশালে সাদা রঙের তলানি পড়বে। তাতেই প্রমাণ
হবে ফরমিক অ্যাসিড তথা ফরমালডিহাইড তথা ফরমালিন।
এখন
কথা হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালনিরে উপস্তিতি পরীক্ষার উপকরণগুলো সহজলভ্য
নয় । আর সবচেয়ে বড় কথা, কেনার সময় যদি সাথে করে এসব নিয়ে যেতে হয়
তাহলে হয়তো কেনাটাই ছেড়ে দিতে হবে।
তাই আমরা জনসাধারণ যাতে সহজ উপায়ে চিনতে পারি বা থেকে কিছুটা রক্ষা পাই সেই চেষ্টাই করি-
১.
ফরমালিনবিহীন মাছের ফুলকা উজ্জ্বল লাল র্বণ , চোখ ও আঁইশ উজ্জ্বল
হয়,শরীরে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়,মাছের দেহ নরম হয় ।অন্যদিকে
ফরমালিনযুক্ত মাছের ফুলকা ধূসর, চোখ ঘোলাটে ও ফরমালনিরে গন্ধ পাওয়া যায়
হয়,আঁইশ তুলনামূলক ধূসর র্বণরে হয় ,শরীরে আঁশটে গন্ধ কম পাওয়া যায়, দেহ
তুলনামূলক শক্ত হয় ।
২.পরীক্ষায় দেখা গেছে পানিতে প্রায় ১ ঘন্টা মাছ ভিজিয়ে রাখলে ফর্মালিনের মাত্রা শতকরা ৬১ ভাগ কমে যায়।
৩. লবনাক্ত পানিতে ফর্মালিন দেওয়া মাছ ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ফর্মালিনের মাত্রা কমে যায়।
৪.প্রথমে চাল ধোয়া পানিতে ও পরে সাধারন পানিতে ফর্মালিন যুক্ত মাছ ধুলে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ফর্মালিন দূর হয়।
৫.সবচাইতে
ভাল পদ্ধতি হল ভিনেগার ও পানির মিশ্রনে (পানিতে ১০ % আয়তন অনুযায়ী) ১৫
মিনিট মাছ ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ ফর্মালিনই দূর হয়।
৬.যে
ধরনের রাসায়নিক দেয়া হোক না কেন যদি একটু আমরা একটু সচেতন হই তাহলে ফল
খাওয়া সম্ভব। আমাদের যা করতে হবে তা হল- খাওয়ার আগে এক ঘণ্টা বা তার
চেয়ে একটু বেশী সময় ফলগুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
৭.লিচু
কাঁচা অবস্থায় সবুজ। পাকার পর হয় ইটা লাল। এখন গাছে রাসায়নিক স্প্রে
করে যার ফলে লিচু গাঁড় মেজেনটা রং ধারন করে তা বড়ই মনমুগ্ধকর। কিন্তু
চকচক করলে সোনা হয় না সেটা মনে রেখে কখনোই গাঁড় মেজেনটা রঙ্গের লিচু কেনা
যাবে না।
৮.সবজি রান্না করার আগে গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন।
৯.বেগুনে
এক ধরনের রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার করা হয় ।এই রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার
ক্ষতিকর না যদি নিয়মানুসারে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকেরা এ
ব্যাপারে অজ্ঞ।তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।প্রতিটি কীটনাশকের ক্রিয়া
একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত থাকে।যেমন- একটি কীটনাশকের সেলফ লাইফ বা
জীবন সীমা ৭দিন, তার মানে কীটনাশকটা ব্যবহারের ৭দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে,
যা কীটপতঙ্গের জন্য ক্ষতিকর।তাই কৃষকদের উচিত কীটনাশক ব্যবহারের অন্তত
৭দিন পর ফলন তোলা।কিন্তু তারা তা না করে ২-১ দিনের মাঝেই ফলন তোলেন।ফলে
কীটনাশকের ক্রিয়া ক্ষমতা থেকে যায়, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে আমাদের উপর।
তাই বাজারে সতেজ, উজ্জ্বল বেগুন না কিনে কিছুটা অনুজ্জ্বল, পোকায় কিছুটা
আক্রান্ত এমন বেগুন কেনাই ভালো।
তথ্যসূত্র:
ফরমালিন টেস্ট- ১. সাইন্স ল্যাবরেটরী কর্তৃক প্রচারিত লিফলেট
২.ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ[বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]